বীরত্বের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদকের নাম বীরশ্রেষ্ঠ্য। যাদের রক্তের বিনিময় অর্জিত এই স্বাধীনতা, জন্ম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠ্য তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজ​য়ের মাসে লেখক অনুপম মাহমুদ লিখেছেন সেই সাত বীর কে নিয়ে যাদের অসীম সাহসীকতার জন্য ভূষিত হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ্য উপাধিতে।

বীরশ্রেষ্ঠ্য ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান…
বীরশ্রেষ্ঠ্য ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান
তার স্বপ্ন ছিলো একটি বিমান ছিনতাই করে যোগ দেবেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। সেইজন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন, আগষ্ট মাসের ২০ তারিখে ১৯৭১ সালে করাচি বিমান ঘাটিতে পাকিস্থান বিমান বাহিনীর সেফটি অফিসারের দায়িত্ব্য পালন করার সময় রাশেদ মিনিহাজ একক উড্ডয়নের জন্য জঙ্গি বিমান নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, সেই সুযোগে মতিউর বিমানটি থামার সংকেত দিলেন নিজের ক্ষমতাবলে। কন্ট্রোল রুম থেকে দেখা যাবে না এমন একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন তাই। ককপিঠ খুলে বিমান থামার কারন জানতে চাইলে মিনহাজ কে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় মতিউর। অজ্ঞান হওয়ার আগ মুহূর্তে ২১ বছর বয়েসি তরুণ বৈমানিক কন্ট্রোল রুম কে জানিয়ে দেন যে বিমান ছিনতাই হয়েছে। বিপদ আঁচ করে মতিউর খুব নিচু দিয়ে বিমান উড্ডয়ন করে উড়িয়ে নিচ্ছিলেন রাডারের চোখ ফাকি দেয়ার জন্য। উড়ে আসছিলেন প্রিয় স্বদেশের দিকে, ভারতীয় সীমান্তের কাছে আসতেই মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে ও হাতাহাতিতে লিপ্ত হয় বিমান নিয়ন্ত্রণের জন্য তখন পেছনে ধাওয়া করছে আরো ৪ টি জঙ্গি বিমান…
ভারতীয় সিমান্তের ৩৫ কিলোমিটারের কাছে খাট্টা নামক স্থানে বিমানটি ভেঙ্গে পড়ে আর দুজনেই মৃত্যু বরণ করেন। বীরত্ব্যপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে বীরশ্রেষ্ঠ্য খেতাবে ভূষিত করে, অপর দিকে পাকিস্থানী সরকার মিনহাজ কে রাষ্ট্রীয় খেতাব দিয়ে সম্মান জানায়। একই ঘটনায় দুই জন দুটি পৃথক রাষ্ট্রের কাছে বিপরীত সম্মানে ভূষিত হওয়ার ঘটনা গোটা বিশ্বে বিরল। শহীদ মতিউর কে পাকিস্থানীরা গাদ্দার উপাধি দিয়ে করাচি এয়ার বেসে চতুর্থ শ্রেণীর একটি কবরস্থানে অত্যন্ত অবহেলায় চিরনিদ্রায় শায়িত করে রেখেছিলো। শহীদ মতিউর এর স্ত্রী মিলি রহমানের প্রচেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৪ জুন তার মৃত্যুর ৩৫ বছর পর দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় সসম্মানে, আর দাফন করা হয় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে তিনি দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিলেন, নরসিংদী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, ভৈরবে ট্রেনিং সেন্টার খুলে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর আমাদের নেই নিজস্ব্য বিমান। সেই ঘাটতি পোষাতে ফিরে গিয়েছিলেন পাকিস্থানে, একটি বিমান ছিনতাই এর পরিকল্পনা নিয়ে…
এই মহান বীরের জন্ম পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডে ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলায়। তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। পাকিস্থান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুল থেকে ডিসটিংশন সহ মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোরের বিমান ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এর নামে নামকরন করা হয়েছে। বিমান প্রশিক্ষনে সেরা ও চৌকশ প্রশিক্ষণার্থীকে দেয়া একটি ট্রফির নামকরন করা হয়েছে এই বীরের নামে।

বীরশ্রেষ্ঠ্য হামিদুর রহমান…
বীরশ্রেষ্ঠ্য হামিদুর রহমান…
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জীবন দিয়ে তারুণ্যের উদ্যোম আর দেশপ্রেমের যে বার্তা দিয়ে গেলেন শহীদ হামিদুর রহমান, তা আমরা কোনদিন ভুলতে পারবো না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ্য বীরশ্রেষ্ঠ্য তিনি…
১৯৫৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খালিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন হামিদুর রহমান। বাবা আব্বাস আলী মন্ডল আর মা মোসাম্মৎ কায়সুন্নেসা। খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্থানীয় নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ১৯৭০ সালে সৈনিক পদে সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম ও শেষ চাকরীস্থল ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, চট্টগ্রাম। ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতে সেনা বিদ্রোহে অংশ নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ৪ নম্বর সেক্টরে সিলেট অঞ্চলে নিয়োজিত ছিলেন।
২৮ অক্টোবর ১৯৭১ সাল, শীমঙ্গলের ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি দখলের উদ্দেশ্যে ৩ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার সাথে রওনা করেন। যুদ্ধ শুরু হলে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন মুক্তিবাহিনী। একটি বাঙ্কার থেকে মেশিনগানে অনবরত গুলি আসছিলো। তরুণ হামিদুর দায়িত্ব্য পেলেন তা অকার্যকর করবার। পাহাড়ের বুক চিরে ছড়া, নালা বুকে হেঁটে হাতে গ্রেনেড নিয়ে এগিয়ে গেলেন। লক্ষ্য আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন হয়তো, তাই গুলিবিদ্ধ হয়েও এগিয়েই গেলেন …
গ্রেনেড ছুড়লেন, আহত অবস্থায় শত্রু বাঙ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের নিষ্ক্রিয় করলেন আর নিজেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আর সেই সুযোগে মুক্তিবাহিনী কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব্যপূর্ণ একটি সীমান্ত ফাঁড়ি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলো। বিজয় তিনি নিজে দেখে যেতে পারেন নি, তবে জীবন দিয়ে তা নিশ্চিত করে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন…

যুদ্ধ শেষ হলে হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের কাছে ভারতীয় ভূখন্ডের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামে দাফন করা হলেও ২০০৭ সালে ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তার দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে এনে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ্য ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ…
বীরশ্রেষ্ঠ্য ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ…
শৈশবেই বাবা মা কে হারিয়েছেন। ছিলেন ভীষণ ডানপিঠে, সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মায়ের নাম জেন্নাতুননেসা। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামে। অভাবের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে প্রথমেই যোগ দেন আনসার বাহিনীতে পরে তৎকালীন ইপিআরে। বিয়ে করেছিলেন নিজ গ্রামেরই একটি কৃষক পরিবারের কন্যা তোতলা বিবিকে।
চাকুরী সূত্রে দিনাজপুর সীমান্তে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে ১০ জুলাই তিনি যশোর সীমান্তে বদলী হয়ে আসেন এবং ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসে আর ফিরে যাননি। দেশের জন্য, একটি মানচিত্রের জন্য, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধকেই বেছে ছিয়েছেন। ৮ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। সৈনিক জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে সহজাত নেতৃত্ব দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোরের গোয়ালহাটি গ্রামে যুদ্ধের অংশ হিসেবে পেট্রোল দেয়ার সময় তাদের এম্বুশ (দুই/তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফাঁদ পাতা কে যুদ্ধের ভাষায় এম্বুশ বলে) করা হয়। সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হলে নেতৃত্বে থাকা নূর মোহাম্মদ ব্যাকুল হয়ে উঠেন তাকে বাঁচানোর জন্য। নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে এলএমজি দিয়ে কাভার করে ফায়ার করতে থাকেন, এমতাবস্থায় মরটারের শেল তার ডান কাঁধে আঘাত হানলে তিনি সিপাহী মোস্তফাকে দায়িত্ব দিলেন তিনি যেন আহত নান্নু সহ বাকিদের নিয়ে নিরাপদে চলে যেতে পারেন। শত্রুদের তিনি একাই ব্যাস্ত রাখেন… এভাবেই একা একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের দলকে নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে যাবার সুযোগ দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

নূর মোহাম্মদের কাছে অস্ত্র ছিলো মোটে একটি আর গুলিও সীমিত। কিন্তু এই সীমিত গোলাবারুদ দিয়েই তিনি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত করেছেন পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর। যুদ্ধ শেষে তার দেহাবশেষ উদ্ধার করে যশোরের কাশিপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ্য মোস্তফা কামাল…
বীরশ্রেষ্ঠ্য মোস্তফা কামাল…
বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেপরোয়া, বাবা মোহাম্মদ হাফিজ ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার, মা মালেকা বেগম। জন্ম হয়েছিলো দ্বীপ জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজীপাড়া গ্রামে। বাবার চাকুরীর সুবাদে বড় হয়েছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে, সেই থেকে তার সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন, কিন্তু বাবা চাইতেন না, ফলাফল গৃহত্যাগ…
১৯৬৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর বাবা মা তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাকে পাঠানো হয়েছিলো সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। পাকিস্থানীরা চক্রান্ত করে বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের যখন নিরস্ত্র করতে চাইছিলেন তখন মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে বন্দী করেন রেজিমেন্ট কমান্ডার কর্নেল খিজির হায়াত সহ অপরাপর পাকিস্থানী সেনা কর্তাদের। পাকিস্থান সেনাবাহিনী তখন শক্তি বৃদ্ধি করে পাল্টা আঘাত হানতে উদ্যত হলো।
১৪ ই এপ্রিল ১৯৭১, হেলিকপ্টার গানশিপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ বিমান নিয়ে ত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হলেন বাঙ্গালি বিদ্রোহী সেনাদল। আলফা কোম্পানীর ২ নম্বর প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মোস্তফা কামাল। ১৭ ই এপ্রিলে সকাল থেকেই পাকিস্থানীরা জোরদার আক্রমণ করে, সারাদিন যুদ্ধ করে টিকে ছিলেন। এই খবর পেয়ে মেজর শাফায়েত জামিল আরেক প্লাটুন যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। বাঙ্গালি সেনাদল একটি ফাঁদে পরে গেলে, পিছিয়ে আসার আদেশ হলো যুদ্ধের কৌশল হিসেবে, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ছিলো নিরবচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার ও পাকিস্থানীদের গতি মন্থর করা। সেই কাজটি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন একজন কমান্ডার হিসেবে। তিনি জানতেন মৃত্যু অবধারিত…
১৮ এপ্রিল সকাল বেলায় পাকিস্থানিরা এগিয়ে এলে তিনি একাই এলএমজি নিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন আর নিরাপদে পিছু হটতে সাহয্য করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। গুলি নিঃশেষ, তবুও তিনি অবিচল, ২০ থেকে ২৫ জন পাকিস্থানী সেনাকে তিনি একাই হত্যা করেছিলেন। আচমকা গুলিবিদ্ধ হলে তিনি নেতিয়ে পরেন। আহত আবস্থায় যুদ্ধের সকল নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে পাকিস্থানীরা তাকে ব্যায়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে…

যেখানে তিনি মৃত্যু বরন করেন, তার পাশেই দরুইন গ্রামের জনগন তাকে পরম মমতা আর ভালোবাসায় সমাহিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার দুঃসাহসিক ভুমিকা ও বীরত্ব্যপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বীরশ্রেষ্ট্য উপাধিতে ভূষিত করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ্য মোহাম্মদ রুহুল আমিন …
বীরশ্রেষ্ঠ্য মোহাম্মদ রুহুল আমিন …
নদীমাতৃক বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানীদের কাছে আতঙ্কজনক ছিলো জলপথের যুদ্ধ। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা মাটিতে ও পানিতে সর্বত্রই হায়েনাদের প্রতিরোধ করেছে।
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের (মতান্তরে ১৯৩৫) ১লা ফেব্রুয়ারী নোয়াখালি জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারী এবং মা জোলেখা খাতুন। স্থানীয় মক্তবে শিক্ষার হাতেখড়ি, তারপর ১৯৪৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন স্থানীয় একটি খবরের কাগজে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্থান নৌ বাহিনীতে যোগ দেন জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পদে। পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ হলে ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার-১ পদে উন্নীত হন ১৯৫৮ সালে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি কর্মস্থল চট্টগ্রাম নৌঘাঁটি থেকে পালিয়ে ১৯৭১সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রিতেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন ও এলাকার ছাত্র যুবকদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এপ্রিল মাসে ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসেন ও মেজর শফিউল্লার অধীনে ৩ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। সেপ্টেম্বরে নৌ বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে তিনি যোগ দেন নব গঠিত নৌ কমান্ডে। গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ১০ নং সেক্টর- নৌবাহিনী সেক্টর।
মিত্র বাহিনীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া দুটি গানবোট “পদ্মা” ও “পলাশ” দিয়ে আমাদের নৌ যুদ্ধের শুরু, টার্গেট মংলা নৌ ঘাঁটি দখল। ভারতীয় বিএসএফ এর টহল জাহাজ চিত্রাঙ্গদা যুক্ত হলে ১০ ডিসেম্বর তারা হিরন পয়েন্টে পৌঁছান। দুপুরের দিকে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই আকাশে বোমারু বিমান.. শত্রু বিমান মনে করে তারা অধিনায়কের কাছে গুলি ছোঁড়ার অনুমতি চাইলেন, কিন্তু তিনি জানালেন এটা মিত্র বাহিনীর বিমান, গুলি করা যাবে না।
কিন্তু মর্মান্তিক ভাবে ভুল বোঝাবোঝি হয় আর মিত্র বাহিনী পাকিস্থানী গান বোট মনে করে আকাশ থেকে গুলি শুরু করে। পদ্মা ডুবে যায়, পলাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন বীর বিক্রম মহিবুল্লাহ। এভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয় ভেবে অধিনায়ক জাহাজ ছেড়ে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বীরশ্রেষ্ঠ্য মহাম্মদ রুহুল আমিন, ফিরে এলেন ইঞ্জিনরুমে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে! ভাবতেই পারেন নি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন পলাশকে সচল ও চলমান রেখে পিছিয়ে আসার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, একটা গোলা এসে পড়ে ইঞ্জিনরুমে। একটি হাত তার উড়ে গিয়েছিলো, ক্রমেই পানি উঠে পলাশ তলিয়ে যাচ্ছিলো… কোনমতে তীরে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু পাকিস্থানী সেনা ও এ দেশীয় রাজাকারের দল তাকে নির্মম ভাবে ব্যায়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়।

অদম্য এই যোদ্ধার লাশ কয়েকদিন রূপসা পারেই পড়ে ছিলো। তার পর গ্রামবাসীরা বাগমারা গ্রামে তাকে সমাহিত করেন। নৌ জাহাজ পলাশ কে বাঁচাতে ও যুদ্ধের ময়দানে বীরত্ব্যপূর্ণ অবদান রাখায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ্য উপাধিতে ভূষিত করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ্য মুন্সি আব্দুর রউফ …
বীরশ্রেষ্ঠ্য মুন্সি আব্দুর রউফ …
খুব ভালো মেশিনগান চালাতে পারতেন। এক নম্বর পজিশনে এই গুরুদায়িত্ব্য পালন করেছেন সামরিক বাঙ্কারে। একটি ঘাঁটির নিরাপত্তা চৌকিতে এই পজিশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিপুল সাহস ও বিবেচনাবোধ জরুরী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি যখন ইষ্ট পাকিস্থান রাইফেলসে, তখনি আঁচ করতে পেরেছিলেন কি হতে যাচ্ছে সামনে। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে তিনি কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসেন, যোগ দেন সশ্রস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তিযুদ্ধে…
যুদ্ধের শুরুতে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথের দায়িত্ব্যে নিয়োজিত ছিলেন মুন্সি আব্দুর রউফ। এই জলপথ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল ৭ তি স্পিড বোট এবং ২ টি লঞ্চ নিয়ে পাকিস্থান বাহিনী আগ্রসর হচ্ছিলো সাথে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র্য। ৩ ইঞ্চি ব্যাসের মর্টার সেলের সহায়তায় পাকিস্থানী সেনারা তীব্র আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন, এমতাবস্থায় পাকিস্থানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। অবস্থা যখন বেগতিক তখন পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু নিরাপদে ফিরে আসতে হলে কাভারিং ফায়ার চালিয়ে যাওয়াটা জরুরী…
১৫০ জন সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য বাঙ্কারে রয়ে গেলেন মুন্সি আব্দুর রউফ। একে একে ৭ টি স্পিডবোট একাই ডুবিয়ে দিলেন, এমতাবস্থায় লঞ্চ নিয়ে পাকিস্থানী বাহিনী মেশিনগানের আওতার বাইরে থমকে যায়। তাদের গতি রোধ হলে ১৫০ জন মুক্তিসেনা নিরাপদে পিছু হটে, কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্থানীরা বিপুল উদ্যমে মর্টার সেল নিক্ষেপ করতে থাকলে একটি মর্টার এসে আঘাত হানে বাঙ্কারে… মৃত্যুকে মেনে নিলেল মুন্সি আব্দুর রউফ।

১৯৪৩ সালে ১ মে ফরিদপুরের মধুখালিতে জন্ম তার। বাবা মুন্সি মেহেদী হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম আর মা মকিদুন্নেসা। ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তিনি পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি। অসীম সাহসী এই বীর যোদ্ধা নিজের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করেছেন ১৫০ জন সহযোদ্ধার জীবন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তার এই বীরত্ব্যপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ্য উপাধিতে ভূষিত করেছে।

 
বীরশ্রেষ্ঠ্য ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর …
বীরশ্রেষ্ঠ্য ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর …
কৈশোরেই তিনি পাঠ করেছেন লেনিন, মাও-সেতুং, চে গুয়েভারার মতো ব্যক্তির সংগ্রামী জীবনের গল্প। মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী তাকে প্রভাবিত করেছে ভীষণ ভাবে। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী আর রাজনৈতিক ভাবে সচেতন একজন মানুষ।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ছিলেন কৃষক এবং মা সাফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও চোখের সমস্যা থাকায় তা অপূর্ণ রয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। অধ্যতনরত অবস্থাতেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কমিশন লাভ করেন ১৯৬৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। ইনফ্যান্ট্রি স্কুল অব ট্যাকটিক্স থেকে অফিসার উইপন কোর্স সম্পন্ন করেন…
যুদ্ধের শুরুতে তিনি নিয়োজিত ছিলেন পাকিস্থান-চীন সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজে। মাত্র একটি পিস্তল হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিয়ালকোট হয়ে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সহ ৪ জন বাঙ্গালি অফিসার পাকিস্থান থেকে পালিয়ে এসেছেন শুনে বিপুল উল্লসিত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা…
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়াল ও ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩/৪ টি দেশি নৌকায় করে রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগোতে থাকেন। তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনকিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগুতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত তখন ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ বাঁধের উপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮/১০ জন সৈনিক দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। যখন আর একটি মাত্র শত্রু অবস্থান বাকি রইল এমন সময় মুখোমুখি সংঘর্ষে বাংকার চার্জে শত্রুর বুলেটে এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে।

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে আনা হয়। অসংখ্য স্বাধীনতা প্রেমিক জনগণ, ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা, অগণিত মা-বোনের নয়ন জলের আশীর্বাদে সিক্ত করে তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তার এই বীরত্ব্যপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ্য উপাধিতে ভূষিত করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে আপনার এই ত্যাগ জাতি শ্রদ্ধা ও সম্মানএর সাথে স্মরণে রাখবে। বিজয়ের মাসে বীরশ্রেষ্ঠ্য ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর … কে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা…

অনুপম মাহমুদ লেখক, উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী
https://www.facebook.com/ThoughtsofAnupam/

ছবি: ইন্টারনেট

আপনার মন্তব্য

Please enter your comment!
Please enter your name here